আমি অরূপ কুমার মুখার্জী। ‘নামে কি আসে যায়’—শেকসপীয়র বলেছিলেন না! সত্যিই তো! নামটা আমার এমন কিছু ভারি নয় কিন্তু আজকাল নিজের নামটা যখন ওদের কচি গলায় শুনি তখন বুকটা ভ‘রে ওঠে। ওদের হাসি চারদিকে এখন সঙ্গীতের মতো বাজে।
খুব ছোটবেলায় দাদুর কাছে শুনেছি এই রাঢ় অঞ্চলে যখনই কোথাও চুরি হত শবরদের নাম উঠে আসত। সাম্প্রতিক অতীতেও ছবিটা পাল্টায়নি। দাদু বলতেন এর কারণ দুটো— প্রথমত অভুক্ত শবররা পেটের দায়ে চুরি করত। দ্বিতীয়ত শিক্ষার অভাবে ওই মানুষগুলোর ন্যায় অন্যায়ের মধ্যিখানের লক্ষ্মণরেখাটা বড় অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তখন থেকেই ‘চোর’ দেগে দেওয়া চারপাশের মায়া জাগানো মুখগুলো দেখলে কষ্ট হত। ওদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতাম। ১৯৯৯ সালে কলকাতা পুলিশের চাকরী পাই। চাকরী পেয়েই মনে হল নিজের পেটের যখন একটা ব্যবস্থা হল তখন অভুক্ত শবর বাচ্চাদের পেটগুলোই বা খালি থাকে কেন। ২০০২ সাল থেকে নিজের মাসমাইনের থেকে একটু একটু করে জমিয়ে জামাকাপড়, বইখাতা কিনে শবরপাড়ায় গিয়ে বাচ্চাগুলোর হাতে দিয়ে আসতাম। ফেরার সময় তেলহীন লাল চুলের বাচ্চাগুলোর ফোকলা দাঁতের হাসি দেখলে মন ভরে যেত। তবুও মনে হত যদি আরেকটু করতে পারতাম— যদি একটা স্কুল গড়তে পারতাম আর যৎসামান্য খাবারের যোগাড় করতে পারতাম ওদের জন্য! ভরা পেট থাকলে তবেই না পড়াশোনায় মন বসে।
একটু সময় লেগেছিল তবু আশা ছাড়িনি, স্বপ্ন দেখাটাও বন্ধ করিনি। বিন্দু বিন্দু জমিয়ে সিন্ধু না হোক একটা তালপুকুর করতেও আমার আরও আট বছর লেগে গিয়েছিল। হ্যাঁ, ২০১০-এ এসে পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুলের জন্ম হল। জায়গা দিয়েছিলেন পুঞ্চা গ্রামের ক্ষিরোদ শশী মুখোপাধ্যায়। সহৃদয় মানুষটি আমাকে সাহায্য করার পর বুঝেছিলাম খাওয়া-পরা আর শিক্ষা দিয়ে শবরদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন আমার মতো অনেকেই দেখেন। বুঝলাম ভবিষ্যতেও চলার পথে সংবেদনশীল মানুষদের পাশে পাবো। ১,৫০,০০০ টাকা ধার করে স্কুল তৈরির কাজ শুরু করলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সাল থেকে ‘পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুলের’ যাত্রা শুরু হল। শুরুর দিনে ১৫ জন শবর শিশু নিয়ে স্কুল শুরু করেছিলাম। আজ ৪৭ জন ছাত্রছাত্রী আছে আমার ‘নবদিশা পরিবারে’। তবে জন্মের পর বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সমস্যার মতো আমার স্কুলেও ছোট-বড়ো সমস্যা আছে। সাধ্যমত চেষ্টা করছি কাটিয়ে ওঠার।
এখনও ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবে চারটে ক্লাসরুম তৈরি করতে পেরেছি। অনেকেই ইদানীং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। ছাত্রছাত্রীদের দুবেলা ডালভাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ পুরুলিয়া ১৯৮৫ ব্যাচের’ প্রাক্তনীরা। জানি এই সব ভাল মনের মানুষদের শুভেচ্ছা আমাদের ‘নবদিশার’ চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। তাই আমার স্কুলের বাচ্চাদেরও একসঙ্গে থাকার মন্ত্র শেখাচ্ছি—‘যদি হও সুজন, তেঁতুল পাতায় ন‘জন’।
Secretary, Puncha Nabadisha Model School. Police Constable, Calcutta Police