সম্পর্ক! বেশ ওজনদার আর দায়িত্বের শব্দ! কিছু সম্পর্ক আমরা জন্মসূত্রে পাই—বাবা, মা, সহোদর, সহোদরা। শৈশব, কৈশোর টপকে বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় পাশাপাশি পথ চলতে গিয়ে আরও একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে— বন্ধু, সতীর্থ! তবে বন্ধু বলুন, সতীর্থ বলুন সব কি আজীবন থাকে! কাছে আসে, দূরে যায় আবার কাছে আসে। আসলে সম্পর্কের বাঁধনও তো দু-রকম— কাঁচা সুতোর আর পাকা সুতোর। পাকা সুতোর সখ্যতার বাঁধন সহজে ছেঁড়ে না। ছিঁড়বে কি করে, যখনই ভাববেন বন্ধুরা বুঝি হারিয়ে গেল— টের পাবেন বুকের ভিতর স্মৃতির পদ্মদিঘিতে মাছের মতো ঘাই মেরে যাচ্ছে। বিষণ্ণ বিকেলে উড়োফোন— দু-দশক পুরোনো সিপিয়া রঙের কন্ঠ— কিরে কেমন আছিস? বন্ধু, কি খবর বল?
ব্যস, অমনি—‘হিয়া টুপটাপ। জিয়া নস্টাল!’
এভাবেই আমাদের পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের ১৯৮৫ সালের প্রাক্তনীদের ফের দেখা হয়ে গেল ২০১৪-এ হোয়াটসঅ্যাপে। ভার্চুয়াল জগতের আলাপেও ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ উঠে এল আন্তরিক গলায়। বেরিয়ে পড়ল বছর ত্রিশ-পয়ত্রিশ আগের সেই অপাপবিদ্ধ মুখগুলো। বন্ধুত্বের ডায়নামিক্স আবার এগিয়ে চলল আগের মতো।
এখন মাঝবয়সে পৌঁছে আমাদের অবস্থা মেছুনীর ঝুড়ির বরফের মাছগুলোর মতো। কারও অফিস ঠান্ডা, গাড়ি ঠান্ডা এমন কি ধমনীর ভিতর রক্তও ঠান্ডা হয়ে এসেছে! তবু ইচ্ছে ঠান্ডা হয়নি। পাকা চুলের সংখ্যায় জীবনবোধ বলছে ভালবাসাও ঠান্ডা হয়নি। তবে ভালবাসার পরিধি স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের গন্ডি ছাড়িয়ে সীমাহীন হতে চাইছে। অপার হতে চাইছে।
আমাদের এই জীবনবোধ গড়ার কারিগর আমাদের ভালবাসার আশ্রমিক স্কুল— পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ। তাই এখন ‘পে-ব্যাক টাইম’।
শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ, আমাদের ভালবাসা আর ১৯৮৫ সালের প্রাক্তনীদের সম্মিলিত বুকের পাটা নিয়ে এগোচ্ছি। আসলে এত বছর পরও পুরুলিয়া জেলার ভূমিপুত্র মনে হয় নিজেদের। সীমিত শক্তি নিয়ে এগোচ্ছি। উদ্দেশ্য বিধেয়— এসব জানিনা, বুঝিনা। শবর, সাঁওতাল, ওঁরাও শিশুদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চাই। অভূক্ত, তেলহীন রুখু চুলের শিশুগুলোর মুখে হাসি দেখতে চাই। সাধ্যমতো ওদের মুখে দুবেলা দু-মুঠো ভাত দিতে চাই। পেটে ভাত না থাকলে যে শিশুমুখে অ-আ-ক-খ ফোটে না— এটুকু জানি! তারপর চাই ওদের আদুল গায়ে নতুন জামাকাপড় উঠুক। গায়ে আচ্ছাদন না থাকলে যে মানুষের আত্মবিশ্বাসও কমে যায়। আর চাই ওরা শিক্ষালাভ করুক। শিক্ষালাভ করে ওরা নিজেদের জানুক, নিজেদের বদলাতে শিখুক, নিজেদের কথা নিজেরা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শিখুক। বলতে পারেন আর কতদিন ওরা সাব-অল্টার্ন হয়ে পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে অন্ধকারে থাকবে!
স্বল্পসময়ে সীমিত সাধ্য দিয়ে এর মধ্যে অযোধ্যা পাহাড়ের বিদ্যাসাগর শিশু শিক্ষা নিকেতনের আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের কম্বল আর তোষক দিয়ে শীতের কামড় থেকে রক্ষা করতে পেরেছি। বরতার সারদামণি মিশনের ছেলেমেয়েদের বইখাতা গুছিয়ে রাখার জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওদের ঘরে বই রাখার বড় বড় খোলা আলমারির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। পুঞ্চার নব দিশা স্কুলের শিশুদের সারা বছরব্যাপী দুবেলা ডালভাতের ব্যবস্থা করতে পেরেছি ভেবে, ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি ভেবে খুব আনন্দ হয়। আর আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে এটা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি ভাবলে আনন্দটা দ্বিগুণ, চৌগুণ হয়ে যায়! তবে আমরা নিমিত্তমাত্র। শুধু ভালবাসার আনন্দে ভালবাসছি। তাছাড়া ওরাও আমাদের নতুন করে ভালবাসতে শেখাচ্ছে। বরফের মাছদের আবার নদীর স্রোতে সাঁতার কাটতে ডাকছে।
আপনাকেও ডাকছে। আপনাদের সবাইকে ডাকছে। হাত বাড়ান, দেখবেন— একটা শবর শিশুর হাত এসে আপনার হাতটা জড়িয়ে ধরছে। ওরা ভালবাসা চায়, ভরসা চায়।